শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ও আদর্শ:
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রামে। পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ও মাতা মনোমোহনী দেবীর জগৎ বরেণ্য-সন্তান। ৩০ ভাদ্র তাল নবমী তিথি ব্রহ্মকালে নেড়ামাথা ওষ্ঠাধরে হাসিমাখা এক দুরন্ত শিশু জন্মগ্রহণ করেন।
দিনে দিন যায়-শুভদিনে মা নামকরণ করেন।
অ=অকুলে পরিলে দীনহীন জনে।
নু=নুয়াইও শির কহিও কথা।
কূ=কূল দিতে তারে সেধো প্রাণপণে
ল=লক্ষ্য করি তার নাশিও ব্যথা।
মূলত অনুকূল কোনো নাম নয়। অনুকূল সমগ্র মানবসত্তার প্রত্যাশা। অনুকূল জীবন চাহিদা, বার্তাবরণ, সংহতি। অনুকূল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রাণবন্ত সমাবেশ। অনুকূল জীবন ও বৃদ্ধি আন্দোলনের প্লাটফরম। অনুকূল প্রেম, ভালোবাসার মূর্ত বিগ্রহ।
বিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি হল। এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফিসের টাকা গরিব বন্ধুর নামে জমা দিয়ে এলেন। বন্ধু পাস করে গেল তার আর হল না। এ সময় খুবই কষ্টের মধ্যে সংসার চলছিল।
মায়ের ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়ার জন্য কলকাতা গেলেন। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে একটা অসুবিধা ছিল। এন্ট্রান্স পাস না হলে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া যায় না। কিন্তু তিনি তো অদম্য উৎসাহী, অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন। বললেন, পাস তো একখানা কাগজ বা সার্টিফিকেট, প্রমাণ করে না পাস করেছি আমি (পরীক্ষা করুন) ইন্টারভ্যুতে বসতে দিন। প্রমাণ হয়ে যাবে।
কথার ঝরনাধারায় চমকিত অধ্যক্ষ, ইন্টারভিউ বোর্ডের ব্যবস্থা করলেন। কয়েকজন চৌকস শিক্ষক চতুর্দিক থেকে প্রশ্ন করলেন_ উত্তরও পেলেন যথাযথ। বিস্মিত পরীক্ষকরা সন্তুষ্ট চিত্তে-ভর্তির সুপারিশ করলেন। কিন্তু তবু তো এ ব্যতক্রিম নিয়ম ভঙ্গ করে কারো পক্ষে যা সম্ভব নয়। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আজো সেই রেকর্ডটি বিদ্যমান।
প্রথম প্রথম শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছায় দীক্ষা দিতেন জননী দেবী। ক্রমশ দীক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় শ্রীশ্রীঠাকুর তার মনমতো কতগুলো লোককে তাঁর পবিত্র পাঞ্জা অর্থাৎ দীক্ষা-দানের অধিকার প্রদান করলেন। এসব শ্বেতবস্ত্র পরিহিত শ্বেতস্বরূপ। এদের নাম দিলেন ঋতি্বক। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ‘ঈশ্বর এক, ধর্ম এক আর প্রেরিত পুরুষগণ সেই একেরই বার্তাবাহী। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান_ এগুলি ধর্ম নয়, মত’, জীবন বৃদ্ধিই ধর্ম। ধর্মের বিভেদ দূর করে_ সব মত ও সম্প্রদায়ের সমন্বয়-বিধান করলেন।
তারই পতাকাতলে অগণিত মানুষ সম্মিলত হতে লাগলো। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মানুষ। গড়ে উঠলো বিশ্বমিলন তীর্থ। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী দিলি্লর পারমাণবিক কেন্দ্রের সিভি রমনের সহকারী, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য। তিনি ঠাকুর দর্শন ও দীক্ষান্তে উক্তি করলেন, ‘ঠাকুর বিজ্ঞানের অতলান্তিক মহাসমুদ্র, কোনো কূল পেলাম না।’ এ সময় শ্রীশ্রীঠাকুর ঋতি্বক এডভাইজার বোর্ড গঠন করেন এবং কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টচার্যকে ঋতি্বকাচার্য্য ও সৎসঙ্গের প্রেসিডেন্ট করেন।
এরপরই প্রবলভাবে শুরু হলো সাধারণ নর-নারীর, দুঃখ-বেদনার সমাধান, প্রশ্ন-উত্তর তথা যথাস্থানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। উড়িষ্যার সু-বিখ্যাত গভর্নমেন্ট উকিল নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের পিতৃদেব জানকীনাথ বসু এবং মাতা প্রভাবতী দেবীর আমন্ত্রণে শ্রীশ্রীঠাকুর বহু ভক্ত সমভিব্যাহারে পুরী গমন করেন এবং মাসাধিককাল ‘হরনাথ লজে’ অবস্থান করেন। পুরীতে সংকীর্তনের বন্যা বয়ে গেল। শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রেমঘন মূর্তি দর্শন করে তাঁর বিদ্যজীবন ও ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে শত শত লোক সৎ নামে দীক্ষা গ্রহণ করে ধন্য হতে লাগলো। জানকীনাথ বসু সস্ত্রীক দীক্ষা নিয়ে তাঁকে গুরুপদে বরণ করলেন। শ্রী অরবিন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রী বারীন্দ্রনাথ ঘোষের কাছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন শ্রীশ্রীঠাকুরের মহিমা শ্রবণ করে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করার জন্য কলকাতার হরিতকী বাগান লেনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হন।
রাজনীতি প্রসঙ্গ : মহাত্মা গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, চরকা, খদ্দর_ অবশেষে পৃথকভাবে স্বরাজ দল গঠন। আলোচনায় ইস্ট উন্ডিয়া কোম্পানি ঈঁষঃঁৎব ্ পড়সসবৎবব নিয়ে অনেক কথা হল।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, দেখুন দাস দা, ডিনি সবটা দেখেন এমন একজন ঝববৎ অর্থাৎ দ্রষ্টাপুরুষ পেছনে না থাকলে কোনো কাজ হয় না। সমাজটা পচে গেছে। দাম্পত্য জীবনে মানুষের সুখ-শান্তি নেই, প্রেম-ভালোবাসা নেই।
বিবাহ নীতি, প্রবর্তন করে সমাজটাকে যদি সংস্কার করতে পারেন তবে কুড়ি, পঁচিশ বছরের মধ্যে এমন কতগুলো যুবক পাবেন_ যে দেশে কর্মীর অভাব দূর হয়ে যাবে। স্বরাজ, স্বাধীনতা আপনি আসবে। দেশবন্ধু পরম আগ্রহে কথা শুনছিলেন, মুগ্ধ হলেন। বললেন, আমাকে কি করতে হবে বলে দিন। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, খুব নাম করা লাগে। কি নাম কিভাবে করতে হবে? ‘আমার মার কাছ থেকে ভালোভাবে জেনে যান।’ অতঃপর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস জননীদেবীর শ্রীচরণে উপনীত হয়ে সৎ নামে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
মহাত্মা গান্ধীজী দেশবন্ধুর কাছে তাঁর মহিমার কথা শ্রবণ করে ‘পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রম’ পরিদর্শনে আসেন। তিনি দেখলেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্পসহ অধ্যাত্ম বিকাশে নিয়মানুবর্তিতা। আদর্শ, আদেশ, দেশ_ এই তিন ফরমুলায় আত্মনিবেদিত মানুষ গড়ার কারখানা। গান্ধীজী বললেন, আপনার আশ্রম পরিদর্শন করে মনে হল_ এটি একটি রাষ্ট্রের মিনি মডেল।
ভারতের রাজনৈতিক আকাশ তখন তমাসাচ্ছন্ন। বিলাসপুর হিন্দু মহাসভার অধিবেশনের পর ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং এনসি চ্যাটার্জি যখন হিন্দু মহাসভার তরফ থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আগমন করেন তখন শ্রীশ্রীঠাকুর তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যা বোধ করেছিলেন তাই বললেন, দেশের সর্বত্র হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভারসাম্য সৃষ্টি করুন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি গঠন করুন। যদি দেশকে বাঁচাতে চান। কিন্তু সেদিনের সেই উক্তির যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করলেন না। ফলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। দেশের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে তিনি মর্মাহত হলেন। দেশের মানুষ যখন তার কথা শুনলো না।
১৯৪৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাবনা থেকে রওনা হয়ে ২ সেপ্টেম্বর বিহারের দেওঘরে চলে এলেন। শ্রীশ্রীবড়দার ব্যবস্থাপনায় বড়াল বাংলোতে উঠলেন। ক্রমে দেওঘর বৈদ্যনাথের বুকে গড়ে উঠলো দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রম_ বিরাট সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বড়াল বাংলোতে প্রথমে উঠলেন। আশ্রমের ঘর-বাড়ি। আসবাবপত্র কারখানা শুরু হল। সৎসঙ্গ মুখপাত্র বাংলা ‘আলোচনা’, হিন্দি সাত্বতী, ইংরেজি খরমধঃব এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী সংবলিত শতাধিক পুস্তক মুদ্রণ পরিকল্পনায় সৎসঙ্গ প্রেস। রসৈযনা মন্দির, দ্যুতদীপ্তি হাসপাতাল, কার্য পরিচালনায় ফিলনথ্রপি অফিস, তপোবন বিদ্যালয়, বীণাপাণি বিদ্যামন্দির, অমরদ্যুতি মহাবিদ্যালয়, বিশাল মেকানিক্যাল ওয়ার্কস ও গ্যারেজ। বড় বড় অতিথিশালা। প্রসাদ গ্রহণের জন্য আনন্দবাজার। উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য রিভলভিং স্টেজ, উৎসব প্যান্ডেল। যতি আশ্রম, চিড়িয়াখানা, মেমোরিয়াল প্রভৃতি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে শা-িলা বিশ্ববিদ্যালয়, গঙ্গা দাড়োয়া পরিকল্পনা।
আশি বছর পূর্ণ হলো। সুযোগ্য পুত্র অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (শ্রীশ্রী বড়দার) ওপর সৎসঙ্গের দায়িত্বভার অর্পণ করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। সৎসঙ্গ আশ্রম তথা সৎসঙ্গের সব সম্পদ নিয়ে গঠিত হল ট্রাস্ট। আরো একটি ব্যবস্থা তিনি করলেন। ভবিষ্যৎ ও তার ধারাবাহিকতা যেন থেমে যেতে না পারে সে জন্য আচার্য্য পদ সৃষ্টি করলেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন কেন হবেন তার পরিপূর্ণ বিধানাবলি তিনি প্রতিষ্ঠিত করে দিলেন।
সব কাজ শেষ। আশিতে হইবে শেষ। তাল নবমী তিথিতে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। আর ১৯৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি শ্লা নবমী তিথির ব্রাহ্মমুহূর্ত ১২ মাঘ পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ভাগবত লীলা সংবরণ করে মহাপ্রয়াণ করলেন।
Read More On IstoKathan:
সরস্বতী দেবীর পূজা সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর
কিভাবে কথা বলতে হয়’ -উত্তরে শ্রীঠাকুর
সক্রেটিসের ফর্ম্মুল’ নিয়ে আলোচনা- বড়দা ও শ্রীশ্রীঠাকুর
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা সম্পর্কে পরামদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুরের কতিপয় উক্তি
https://istokathan.com/%e0%a6%8f%e0%a6%87-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b6%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%87-%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%b8%e0%a7%8e/
https://istokathan.com/%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a7%80%e0%a6%a0%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%85%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%af%e0%a6%be/